কুমিল্লা নগরজুড়ে অস্ত্র হাতে মহড়া দিয়েছে কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্যরা। নিকট-অতীতে এমন বড় অস্ত্রের মহড়া দেখেনি নগরবাসী।  শুক্রবার (২৫ এপ্রিল) বিকালে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয় এবং বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে মিছিল করে। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে কুবির ভর্তি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা সবচেয়ে বেশি ভীতসন্ত্রস্ত হন। এ সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা ছিলো রহস্যজনক। প্রকাশ্যে এমন অস্ত্রবাজী হলেও পুলিশের নিস্ক্রীয়তা প্রশ্ন তুলেছেন সাধারণ মানুষ।

ঘটনার পরপরই অভিযান চালিয়ে চাকু-এন্টিকাটারসহ তিনজনকে আটক করেছে পুলিশ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুক্রবার বিকাল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত নগরীর রানীর দিঘির পাড়, তালপুকুরপাড় ও আদালতপাড়া এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মহড়া দেয়। তাদের অনেকের হাতেই ছিলো দেশীয় অস্ত্র। স্লোগান তুলে তারা যখন এগিয়ে যাচ্ছিল-এ সময় সড়কের দুপাশে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে দাঁড়িয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন।

একই সময়ে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক শাখায় কুবির ভর্তি পরীক্ষা চলাকালে এ সড়ক দিয়ে রানীর দিঘির দক্ষিণপাড়ে কয়েক শ’ কিশোরকে দেশীয় অস্ত্র হাতে ছোটাছুটি করতে দেখা যায়। তাদের এই সশস্ত্র অবস্থা দেখে কলেজ কেন্দ্রের বাইরে রানীর দিঘিরপাড়ে বিভিন্ন জেলা থেকে সন্তানদের নিয়ে আসা অভিভাবকরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।

আতঙ্কিত এক অভিভাবক বলেন, মেয়ে পরীক্ষা দিচ্ছিল, আমরা বাইরে অপেক্ষা করছি। এমন সময় অন্তত ৫ শতাধিক পোলাপান হাতে চাপাতি, বটি দা নিয়ে মহড়া দিচ্ছিল। এটা অন্তত আতঙ্কের বিষয়। অথচ এখানে প্রশাসনের কোনো লোকজন নেই, প্রশাসন কোথায় গেলো। এমন পরিস্থিতি কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না।

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, বিকাল ৪টার দিকে  ১৬-১৭ বছর বয়সের কিশোরেরা হাতে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে কলেজ গেটের সামনে এসে জড়ো হন। তাদের কারও হাতে ছিল লোহার রড, হকিস্টিক, বাঁশের লাঠি এবং দেশীয় অস্ত্র। আতশবাজি, বাইকের হর্ন, গালিগালাজ ও ভয়ভীতির মাধ্যমে নিজেদের গ্যাংয়ের শক্তি প্রদর্শন করে। তালপুকুরপাড় এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা জানান, এক থেকে দেড়শ কিশোর ছেনি, রামদা ও চাপাতি হাতে এলাকায় আসে এবং ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে গোটা এলাকার মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে আদালতপাড়া এলাকায় কিশোর গ্যাং তাদের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মহড়া দেয়। এ সময় সড়কে চলাচলরত যানবাহনের চালকরা ভয়ে সড়কের পাশে অবস্থান নেয়।

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ উচ্চ মাধ্যমি শাখায় কুবির ভর্তি পরীক্ষার্থী ইকবাল বলেন পরীক্ষার সময় সময় বাইরে থেকে মিছিলের শব্দ শুনতে পেলাম। শব্দ শুনে দ্রুত বেইরে আসলাম। এসে দেখি অনেক গুলো ছোট ছোট ছেলে। তাদের বয়স সর্বোচ্চ ১৬ বছর হবে। তাদের অনেকের হাতে রামদা, চুরি, চাপাতি দেখেছি। তারা আতশবাজিও ফোটাচ্ছিল। তাদের কাছে গিয়ে বললাম এখানে পরীক্ষা চলছে এভাবে আওয়াজ করবেন না। তারা আমাকে তাাদের অস্ত্রগুলো দেখিয়ে আরও বেশি আওয়াজ করে ছুটে চললো। তারপর পুলিশের কাছে যখন এই ব্যাপার বললাম তারা এই ব্যাপারে একটুও মাথা ঘামালো না।'পরীক্ষার জন্য আগত অনেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবক নিরাপত্তার অভাবে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পড়েন। একাধিক অভিভাবক বলেন, “আমার সন্তান ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসেছে, আর এমন আতঙ্কজনক পরিস্থিতি দেখে আমরা চিন্তায় পড়ে গেছি। প্রশাসন কী করছে?”

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী হাসিন ইশরাক মিজার বলেন, '"৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে কুমিল্লা নগরীতে কিশোর গ্যাংয়ের তাণ্ডব উদ্বেগজনক হারে বেড়েই চলছে। এক্ষেত্রে কুমিল্লার প্রশাসনের নীরবতা এর প্রধান কারণ বলে আমি মনে করি, কেননা এরকম ঘটনা এখন প্রায়শই ঘটছে কিন্তু প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যাবস্থা নিচ্ছে না। মাঝেমধ্যে দু'একজনকে ধরপাকর হচ্ছে কিন্তু তারা আবার কিছুদিন পর ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে তাদেরকে যারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে তারা পুরোপুরি নাগালের বাইরেই রয়েছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে এ শহর আরও অনিরাপদ হয়ে উঠবে বলে মনে করি। এ সমস্যা নিরসনে আমি দ্রুততম সময়ে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানাই।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল হাকিম বলেন, 'আমি এই ঘটনা জানার সাথে সাথেই সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেছি। উনারা যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন বলে জানিয়েছেন।'

কুমিল্লার কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহিনুল ইসলাম জানান, নগরীর বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের মহড়ার খবর পেয়ে পুলিশ তাৎক্ষণিক অভিযানে নেমে পড়ে। এ সময় একটি গ্রুপের মহড়ায় ধাওয়া করে তিনজনকে আটক করা হয়েছে। বাকিরা পালিয়ে গেছে। তাদের কাছ থেকে ছুরি, চাকু এন্টি কাটার উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশের অভিযান চলছে। ভিডিও ফুটেজ দেখে চিহ্নিত করে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হবে।