বুধবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৪, , ১৯ রবিউল সানি ১৪৪৬

ফের জামায়াতের নিয়ন্ত্রণে আসছে ইসলামী ব্যাংক?

ফের জামায়াতের নিয়ন্ত্রণে আসছে ইসলামী ব্যাংক?
ছবি/সংগৃহীত

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ আবারও জামায়াতে ইসলামীর নিয়ন্ত্রণে আসার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এরইমধ্যে আলোচনা করেছেন জামায়াত ও ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও সায় আছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ডেপুটি গভর্নর জানিয়েছেন, সরকার পরিবর্তনের ফলে এস আলম গ্রুপের ব্যাপারেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মনোভাব বদলেছে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক এখন থেকে এস আলম গ্রুপকে আগের মতো সাপোর্ট দেবে না। বরং এস আলমের মাধ্যমে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক সোচ্চার হবে।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক এখন এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে, যাতে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তিনি উল্লেখ করেন, ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে বেশি রেমিট্যান্স পাওয়ার সুযোগ আছে। সেক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা যদি আগের কর্তৃপক্ষের কাছে চলে যায়, তাতেও বাংলাদেশ ব্যাংকের সায় আছে।’

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ব্যাংক খোলার প্রথম দিনেই বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংকে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) রাজধানীর দিলকুশায় ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু কর্নার ভাঙচুর করেছেন  বিক্ষুব্ধ কিছু কর্মকর্তা। পাশাপাশি মানবসম্পদ বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তাকে মারধরও করা হয়েছে। এ ঘটনার পর ব্যাংকের সিবিএ নেতা আনিসুর রহমান জানিয়েছেন, ২০১৭ সালের পরে যত নির্বাহী এসেছেন, তারা আর ব্যাংকে ঢুকতে পারবেন না। বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা শান্ত হোন। যে ইসলামী ব্যাংক দখল হয়েছে, তা আবার ফিরে আসবে। এমডি (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) মহোদয় আমাকে প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়েছেন।’আনিসুর রহমান বলেন, ‘২০১৭ সালের পর থেকে পরীক্ষা ছাড়া অনিয়মের মাধ্যমে যেসব নিয়োগ হয়েছে, সেসব নিয়োগ বাতিল করা হবে। একইসঙ্গে ওই সময়ের পরে যাদের চাকরি অবৈধভাবে বাতিল করা হয়েছে, তাদের চাকরি পুনরায় ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এছাড়া গত সাত বছরে যারা পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন, তাদের যথাযথভাবে পদোন্নতি দেওয়া হবে।’

এদিকে জামায়াতের ইসলামীর একটি প্রতিনিধি দল মঙ্গলবার ব্যাংটির  ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুল মাওলার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। জামায়াত নেতারা ব্যাংকটিকে  আগের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রক্রিয়া শুরু করার পরামর্শ দেন। মনিরুল মাওলা তাতে সায় দিয়েছেন বলে জানান ব্যাংকটির সংশ্লিষ্ট সূত্র। এ ব্যাপারে ব্যাংকের এমডির মোবাইলে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

এ প্রসঙ্গে ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউটকে বলেন, ২০১৬ সালের আগে যাদের মালিকানায় ব্যাংকটি পরিচালিত হতো, আবার হয়তো তাদের মালিকানায় চলে আসবে। ব্যাংকের বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী চাইছেন— ব্যাংকটি আগের মতো জামায়াতে ইসলামীর তদারকিতে চলুক। তিনি বলেন, ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আবু নাসের মোহাম্মদ আবদুজ জাহেরের মতো কাউকে চেয়ারম্যান পদে বসানো সম্ভব হলে এই ব্যাংকটির প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে, আমানত বাড়বে। আগের মতো আবার রেমিট্যান্স আসতে শুরু করবে। তিনি বলেন, ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ও ম্যানেজমেন্টের শীর্ষ পদগুলোতে পরিবর্তন আনা হলে ব্যাংকটি আবার ঘুরে দাঁড়াবে।

ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে ব্যাংকটির মালিকানা পরিবর্তনের পর গত সাত বছরে অনেক কর্মকর্তাকে জোরপূর্বক চাকরি ছাড়তে বাধ্য করার অভিযোগ রয়েছে। আবার অনেক জুনিয়র কর্মকর্তাকে সিনিয়র পদে বসানো হয়। এছাড়া ব্যাংকটি থেকে বড় অঙ্কের অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে বলে মালিকদের একটি পক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে জানা গেছে, শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর মঙ্গলবার সকালে ব্যাংকে এসে কিছু কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধু কর্নার ভাঙচুর করেন। এরপর কর্মকর্তাদের অনেকে অন্য কর্মকর্তাদের খুঁজতে থাকেন, যারা মালিকপক্ষের অবৈধ নির্দেশে সাবেক কিছু কর্মীকে ব্যাংক ছাড়তে বাধ্য করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

যেসব কর্মকর্তা ইসলামী ব্যাংক থেকে মালিকপক্ষের অভিপ্রায় অনুযায়ী টাকা বের করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে, বিক্ষুব্ধ এই কর্মকর্তারা তাদেরও খুঁজতে থাকেন। এ সময় তারা মানবসম্পন্ন বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তাকে মারধর করেন। পাশাপাশি ব্যাংক এলাকায় নানা রকম স্লোগানও দেওয়া হয়।

বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন ইসলামী ব্যাংকের অপারেশন বিভাগের প্রধান এবং সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট কামালউদ্দিন জসিম। তিনি কর্মকর্তাদের বলেন, তার সঙ্গে ব্যাংকের এমডির কথা হয়েছে। ব্যাংকে অনিয়মের মাধ্যমে যেসব নিয়োগ হয়েছে, তা বাতিলের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বর্তমানে এস আলম ও জামায়াত সমর্থিত দুটি গ্রুপ তর্ক-বিতর্ক লিপ্ত রয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে এস আলমের বিপক্ষে একটি পক্ষ মিছিল করেছে।

তবে ইসলামী ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ব্যাংকের জুনিয়র স্টাফরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন। বিভিন্ন স্লোগান দিয়েছেন। ব্যাংকটির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আগে ইসলামী ব্যাংকে পিওনদের অফিসার হওয়ার সুযোগ ছিল, এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর পিওনদের প্রমোশন বন্ধ ছিল এতদিন। এ কারণে বিক্ষুব্ধ স্টাফরা মিছিল করছেন ও স্লোগান দিয়েছেন।

জানা গেছে, ইসলামী ব্যাংকে এস আলম গ্রুপের বিশেষ লোক বলে পরিচিত দুই ডিএমডি মঙ্গলবার অফিসে আসেননি। ব্যাংকের আরেক ডিএমডি রেজাউর রহমানকে মারধর করেছে আইবিবিএলের লোকজন। এছাড়া এস আলমের ‘বিশেষ কৃপায়’ প্রমোশন পাওয়া আরও অন্তত চার-পাঁচজনকে মারধর করেছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা।

দেশে শরিয়াহ ভিত্তিতে পরিচালিত ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড সবচেয়ে বড়।  প্রতিষ্ঠার পর থেকে ব্যাংকটির পর্ষদে জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাই ছিলেন। তাদের মধ্য থেকেই চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য নীতিনির্ধারক পদে নিয়োগ দেওয়া হতো। নির্বাহী ও নিচের পর্যায়েও ওই ঘরানার জনশক্তিই বেশি। ফলে ব্যাংকটি পরিচালিত হতো জামায়াতের আদর্শ নিয়ে।

জামায়াতে ইসলামীর প্রচেষ্টায় ১৯৮৩ সালে প্রথম প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী ব্যাংক দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ইসলামী ব্যাংক। এর স্লোগান ছিল ‘কল্যাণমুখী ব্যাংকিং ধারার পথপ্রদর্শক’। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পসহ রফতানিমুখী শিল্প এবং দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্পের মতো নতুন নতুন খাতে ব্যাংকটি আর্থিকসেবার দুয়ার খুলেছিল। বিভিন্ন স্থানীয় শিল্প ও এসএমই দাঁড়িয়েছে ইসলামী ব্যাংকের ঋণের ওপর। প্রতিষ্ঠাকালে এই বেসরকারি ব্যাংকের ৭০ শতাংশ পুঁজি জোগান দিয়েছিলেন বিদেশিরা। এস আলাম গ্রুপ ব্যাংকটিকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর অনেকটা ঝুঁকিতে পড়েছে।

মালিকানা বদলের প্রক্রিয়া যেভাবে শুরু হয়

২০১৫ সালে জঙ্গি অর্থায়নের পাশাপাশি রাজনৈতিক সহিংসতায় অর্থায়নের অভিযোগ তুলে জামায়াতের ইসলামীর কাছ থেকে ব্যাংকটির মালিকানা ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দফতরের আওতাধীন প্রভাবশালী একটি গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও কাজে লাগানো হয়। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের শুরুর দিকে জনস্বার্থ, আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও ব্যাংকের জন্য ক্ষতিকর কার্যকলাপ প্রতিরোধে ইসলামী ব্যাংকের  ওপর বিশেষ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই নিয়ন্ত্রণের কারণে ব্যাংকের দ্বিতীয় পর্যায়ের শীর্ষ নির্বাহী উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) নিয়োগের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করে। ওই সময় বিধিবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের অভিযোগে ডিএমডি নুরুল ইসলামের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে ইসলামী ব্যাংকে স্বতন্ত্র পরিচালক ছিলেন ৫ জন। তাদের সবাইকে ২০১৬ সালে ব্যাংক থেকে বের করে দেওয়া হয়। বসানো হয় শামীম আফজালসহ সরকারের পছন্দের চারজন স্বতন্ত্র পরিচালককে। শুধু তাই নয়, ওই বছরের শুরুতে  ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবু নাসের মুহাম্মদ আবদুজ জাহেরকে বের দেওয়া হয়। তার স্থানে বসানো হয় মুক্তিযোদ্ধা প্রকৌশলী মোস্তফা আনোয়ারকে। ওই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে স্বতন্ত্র পরিচালক ও অডিট কমিটির চেয়ারম্যান এন আর এম বোরহান উদ্দিনের বিরুদ্ধে রাজধানীর মতিঝিল থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন।  মামলার পর এন আর এম বোরহান উদ্দিনকে ব্যাংক থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

মালিকানা পুরোপুরি বদলে যায় ২০১৭ সালে

রাজধানীর র‍্যাডিসন হোটেলে ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে ব্যাংকটির তখনকার চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আব্দুল মান্নানকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। ঘটানো হয় অপ্রীতিকর ঘটনা। পরিবর্তনের কারণ হিসেবে ব্যাংকটিকে জামায়াতমুক্ত করার কথা বলা হয়েছিল। ওই দিন নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন সাবেক সচিব আরাস্তু খান ও এমডি পদে দায়িত্বে আসেন চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ইউনিয়ন ব্যাংকের এমডি আবদুল হামিদ মিঞা। বাজার থেকে নতুন শেয়ার কিনে ব্যাংকটির এসব পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে এস আলম গ্রুপ। এস আলাম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার এক বছরের মধ্যে  কয়েক দফায় ব্যাংক ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন হয়। একজন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) ও তিনজন উপব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ (ডিএমডি) একযোগে পাঁচজনকে পদত্যাগ করতে  বাধ্য করা হয়।